মিয়ানমারের রাখাইনে পুলিশের চারটি তল্লাশি চৌকিতে হামলায় ১৩ জনকে হত্যা করেছে স্বাধীনতাকামী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘আরাকান আর্মি’। এ ঘটনায় আহত আরো নয় পুলিশকে বিদ্রোহীরা নিয়ে গেছে।
শুক্রবার মিয়ানমারের ৭১তম স্বাধীনতা দিবসে বুথিডং এলাকায় এই হামলা হয় বলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জানিয়েছে। হামলার ঘটনা স্বীকার করেছে আরাকান আর্মি (এএ)।
গত কয়েক মাস ধরে রাখাইনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা চালাচ্ছে। তবে শুক্রবারের হামলা বড় আকারের। এর আগে ডিসেম্বরের শেষ দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয় আরাকান আর্মির।
আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইন থু খা রয়টার্সকে বলেছেন, তাদের সদস্যরা চারটি পুলিশ পোস্টে আক্রমণ করেছে এবং পরে সাত ‘শত্রুর’ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আমরা তাদের ক্ষতি করব না।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাদের সদস্যদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।’
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জ মিন তুন রয়টার্সকে বলেন, মংডু ও বুথিডং শহরের উত্তরাংশে (বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে) পুলিশ পোস্টগুলোতে শুক্রবারের এই হামলার ঘটনায় পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। সেনাবাহিনী ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে যাবে।’
তবে হামলায় কতজন নিহত হয়েছেন এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীটি কতজনকে ধরে নিয়ে গেছে সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার ৭১ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিয়ানমারজুড়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই হামলা হয় বলে জ মিন তুন জানান। যদিও আারাকান আর্মির খাইন থু খা বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে এই হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও স্বাধীন নই। আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবসও নয়।’
রাখাইনের এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে রাখাইনরাও রয়েছে, এদের সবাই মিয়ানমার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত। অপরদিকে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার।
তবে গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপরেও নেমে এসেছে দেশটির বাহিনীর খড়গ। সম্প্রতি রাখাইনের স্বাধীনতার দাবিতে প্রায় পাঁচ দশক আন্দোলনরত বৌদ্ধ বিদ্রোহীদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশের বড় আকারের সংঘর্ষের খবর আসছে। আর সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন ছেড়ে পালাচ্ছে সেখানকার বৌদ্ধরা।
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় বৌদ্ধ রাখাইন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়তে থাকা লড়াইয়ের মধ্যে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীগুলোর বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে। এদের মধ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই হাজার লোককে বাড়ি ছাড়া করা হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, গত সপ্তাহে রাখাইনে লড়াইয়ের জেরে চলতি সপ্তাহে দেড় হাজার লোককে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এর আগে ৮ ডিসেম্বর সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে আরও এক হাজার লোককে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল।
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চল ও উত্তরপূর্বাঞ্চলের শান ও কাচিন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে স্থবির হয়ে থাকা শান্তি আলোচনা শুরু করতে গত মাসে সামরিক বাহিনী চার মাস লড়াই বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যকে এই সুযোগের বাইরে রাখা হয়। এতে দেশটির সামরিক বাহিনীর আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) আরকান আর্মির অন্যতম বন্ধু সংগঠন বলে বিবেচনা করা হয়। এএ, কেআইএ, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) মিলে ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’ নামের গেরিলা জোট করেছে। এরা সবাই মিলে মিয়ানমারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে।
কাচিন প্রদেশেই রয়েছে আরাকান আর্মির কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর। সেখান থেকেই তারা আরাকানের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী সর্বশেষ অভিযানের অজুহাত হিসেবে তাদের ওপর গেরিলা হামলার ঘটনাকে দায়ী করছে।
এর আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় ‘আরসা’ নামের একটি সংগঠনের তৎপরতার কথা দাবি করেছিল মিয়ানমার সরকার। আর এখন সেই রাখাইনে এএর হামলার কথা বলা হচ্ছে।